★*★আমি এবং সেই মহিলা★*★

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৯ মে, ২০১৬, ০৪:৪৮:৩৮ বিকাল

৩.

দেশের বাইরে আমার সময় কেটে যাচ্ছিল এক অন্য আবহে। আমার নতুন বন্ধু হলো। এদের ভেতরে একজন ‘প্রিয় বন্ধু’ও হলো। আমার জীবনকে নতুন উদ্যমে প্রেরণা দিতে সে আমার হাত ধরলো। আমাদের ভেতর ভালোলাগা গড়ে উঠলো। একসময় ভালোবাসায় রুপ নিলো। আর কখন যে ভালোবাসা পুড়ে পুড়ে প্রেম হলো, আমি নিজেই জানলাম না। তবে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে এই মেয়েটি আমার পুরো স্বত্বা জুড়ে রইলো। আমাদের দুজনের পড়া-লেখা শেষ হলো। দুজনেই ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরতে উদগ্রীব হলাম।

আমি কখনো আমার হবু জীবনসঙ্গিনীকে আমার মা’র সম্পর্কে কিছুই বললাম না। সে একবার আমার রক্তের সম্পর্কের কে কে আছে জানতে চাইলে, আমি বললাম কেউ নেই আমার। আমি একা। তখন ভুলেও আমার এক চোখা মাকে একটুও মনে পড়ল না।

দেশে ফিরলাম দুজন। আমার প্রিয় বন্ধুর বাবা-মা এয়ারপোর্টে আমাদেরকে রিসিভ করলেন। তাদের বাসায়ই উঠলাম। আমার সম্পর্কে তারাও একই প্রশ্ন জানতে চাইলেন। আমার উত্তরও ছিল একই। আমার হবু শ্বশুরের উচ্চ-বিত্ত আর চাকচিক্য আমাকে আরো ধাধিয়ে দিলো। খুব দ্রুতুই আমি একটা ভালো জব অফার গ্রহণ করলাম।

আমাদের দুজনের বিয়ে হলো। সময় ফুরফুরে মেজাজে বয়ে যেতে লাগল। আমি আমার মা’কে একবারও দেখতে গেলাম না। দুজনে ভিন্ন দুই শহরে থাকলেও এতটা দূরত্ব ছিল না যে, আমি যেতে পারতাম না। কিন্তু দূরত্ব ছিল আমার মনে। আমার চাওয়া-পাওয়ার প্রাণকেন্দ্রের ইচ্ছেপালকে ধুলা জমেছিল। তাই মনের অগোচরেও আমি সেই মহিলাকে নিয়ে একবারও ভাবলাম না। সময় বয়ে গেলো। আরো ধুলার আস্তরণ পড়ল আমার মনের আরশিতে একজন এক চোখের গরীব মহিলা কে কেন্দ্র করে।

আমার দুই কন্যা একে একে পৃথিবীতে এলো। তারা বুঝার মত বড়ও হলো। আমার অনেক উন্নতি হলো। আমি একটা চমৎকার বাড়ি বানালাম। গাড়ি কিনলাম। আমার ভূবন একদা’র আমার বসবাসের সেই বস্তি জীবনের তুলনায় যোজন যোজন দূরত্বের ছিল।

একদিন সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে আমি মেয়েদের নিয়ে বাসায় আমার একান্ত মুহুর্তগুলি কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ ডোরবেলের আওয়াজ। সোফায় দুই মেয়েকে পাশে নিয়ে বসে মৃদু খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিলাম। বড় মেয়ে দরজা খুলতে গেলে ছোটজনও পিছু নিলো। দরজা খুলেই বড় মেয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে এলো। ওর দেখাদেখি ছোটজনও একই কাজ করতেই, আমি সামনে আগালাম। উন্মুক্ত দরজার ওপাশে আজ এতগুলি বছর পরে আমি সেই মহিলাকে দেখলাম! বয়সের ভারে আরো নুয়ে পড়েছে। তার জীর্ণ মলিন পরিচ্ছদ আরো মলিন হয়েছে। শূন্য চোখের গহ্বরটি তাঁকে আরো ভয়ংকর কদাকার করে তুলেছে। আসলেই হঠাৎ দেখে যে কেউই ভয় পাবে। তবে কয়েকমুহুর্ত পার হলে, আমার মেয়েরা সাহস করে সামনে এলো এবং এবারে ভয়ের পরিবর্তে তারা সেই কদাকার মহিলার প্রতি উপহাসের হাসি হাসলো। আমার ভেতরে কিছু একটা কি যেন ছিড়ে গেলো। আমি ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে তাঁকে বললাম, ‘ তোমার এত বড় সাহস কি করে হলো আমার বাসায় আসার? আমার মেয়েদেরকে তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছে, এখুনি এখান থেকে বের হয়ে যাও!’

সেই মহিলা তার ভালো চোখটি দিয়ে এক পলক আমাকে এবং আমার মেয়েদেরকে দেখলো। এই প্রথম সে আমার মেয়েদেরকে দেখছে। আমাকেও আজ এতগুলি বছর পরে দেখলো। মুখে লজ্জার হাসি ফুটিয়ে সে বললো বড্ড শান্ত স্বরে, ‘ওহ! আমাকে মাফ করবেন, আমি ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছি।‘ এক মুহুর্ত ও সে আর না দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। একবারও পেছনে ফিরলো না।

আরো কয়েকমাস পরে, আমার সেই ছেলেবেলার স্কুল থেকে একটি চিঠি এলো আমাদের ব্যাচের ‘রি-ইউনিয়নের’ দাওয়াত নিয়ে। আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই সেখানে যাবার ব্যাপারে মনঃস্থির করলাম। আমার বউকে মিথ্যে বললাম যে, অফিসের কাজে আমাকে অমুক শহরে যেতে হবে।

(ক্রমশঃ)

(আগামি পর্বে সমাপ্য)

বিষয়: সাহিত্য

৮৫০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

368510
০৯ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:০৯
ঘুম ভাঙাতে চাই লিখেছেন : সত্যি ভয়ংকর! ভাগ্যিস এটা গল্প সত্যি নয়। সত্যি যেন কখনো না হয়। যার শরীরে আমি এলাম, যার মানুষিক-শারীরিক বৈশিষ্ট নিয়ে আমি বড় হলাম তাকে অস্বীকার করব!! মা সুন্দরী নয় বলে অন্যকে কি মা বানানো যায় !!
০৯ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:১৮
305862
মামুন লিখেছেন : হ্য এটা গল্প।
কিন্তু দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলিতে যে সকল মা এবং বাবারা থাকেন, তাদের সকলেরই এমন কোনো না কোনো বিবর্ণ গল্প রয়েছে।
আমি যে গ্রুপে জব করি, সেখানের সাথে হোতাপাড়া বৃদ্ধাশ্রমের একটা লিংক রয়েছে, তাই এমন অনেক অপ্রিয় গল্প আমার জানা হয়।
ধন্যবাদ আপনার সুন্দর অনুভূতি জানানোর জন্য।
অনেক ভালো রাখুক আপনাকে মহান আল্লাহপাক।
368513
০৯ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:৩২
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু শ্রদ্ধেয় মামুন ভাইয়া। প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম পড়ে। যাক পরে অবশ্য ভূল ভাঙলো। প্রতিমন্তব্য থেকে।

সবাইকে নিয়ে সর্বত ভালো থাকেন এই দুয়া করি।
১০ মে ২০১৬ সকাল ০৬:৫৭
305950
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম প্রিয় আপুজি।
আপনি কি আমার জীবনের গল্প মনে করেছিলেন!
হ্যা, জীবন চলার পথে আমারও টুকটাক মায়ের সাথে একটু আধটু কাছে-দূরের অনুভূতি হয়েছে, তবে তা এতটা ব্যপক হয়নি কখনো।
অনুভূতি রেখে যাবার শুভেচ্ছা গ্রহন করুন।
368534
০৯ মে ২০১৬ রাত ০৮:১৭
শেখের পোলা লিখেছেন : জানা থাকলেও নতুনকরে আবার শুনছি। কেননা এতে শিক্ষনীয় কিছু অবশ্যই আছে।
১০ মে ২০১৬ সকাল ০৬:৫৮
305951
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
অনেক ভালো থাকুন।
শুভ সকাল।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File